দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় আয়তনের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন। ইতিমধ্যেই নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন শুধু ভোট দেয়ার পালা।
আষাঢ়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝে টানটান উত্তেজনা, প্রচন্ড স্নায়ুচাপ, কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী, উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আশঙ্কার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (গাসিক) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে নিরাপত্তা বলয়ে ঢাকা পড়েছে পুরো সিটি করপোরেশন এলাকা। গাজীপুরের রিটার্নিং অফিসার মতিয়ার রহমান বলেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।
শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। শনিবার এ সিটিভুক্ত এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ত্রুটির কারণে প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েও ভোটগ্রহণে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার হচ্ছে না।
এখন সারাদেশের মানুষের একটাই হিসেব কে হচ্ছেন গাজীপুরের নগরপিতা? কারণ এই নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের ওপরই নির্ভর করছে সরকারের প্রেসটিজ এবং বিএনপির আন্দোলনের ইস্যু। তাই গাজীপুরের বিজয় ঘরে পেতে চায় সরকার। এ জন্য সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এই বিজয় আনতে।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে খবর নিয়ে জানা গেছে, উপরে উপরে ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের কথা শোনা গেলেও ভিতরে ভিতরে শোনা যাচ্ছে ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নানের ভোটব্যাংকের কথা।
খায়জুল হক নামে এক ভোটার জাস্ট নিউজকে জানান, আমি মনে করি দেড় থেকে দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে এমএ মান্নান জয়ী হবেন। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, একদিকে জাতীয় পার্টির ভোট, হেফাজতে ইসলাম, ১৪ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর ভোট- এসব কারণে এমএ মান্নানের জয়ের আশা করা যাচ্ছে।
সাত মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আলোচিত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ১৪ দল প্রার্থীর দোয়াত-কলমে নাটকীয়ভাবে সমর্থন করলেও তিনি নিজের ভোটটি কোথায় দেবেন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আর বিএনপিও তাদের নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়েছে জয়ের ধারাকে অব্যাহত রাখতে। সব কিছু মিলিয়ে সাধারণ ভোটাররা তাদের ভোটের মাধ্যমে নীরব রায় জানাবে। কে জিততে পারে বা কার মাঠ ভালো এমন প্রশ্নের কোনো ধরনের মন্তব্য করতে নারাজ ভোটাররা।
এদিকে সরকারি দলের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নানও জয়ের ব্যাপারে আস্থাশীল।
মান্নান বলেন, জনগণের রায় টেলিভিশন মার্কায় আসবে। তবে এ নির্বাচনে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জয়কে পেতে উভয় দলই মরিয়া। তাই সংঘাত অনিবার্য।
নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তাহলে আমি লাখ লাখ ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হবো ইনশাআল্লাহ। নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিবেন কিনা জানতে চাইলে মান্নান জাস্ট নিউজকে বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ফলাফল যাই হোক মেনে নেবো। কিন্তু এর বিপরীত হলে গাজীপুরের জনগণ ফলাফল মানবে না। আমিও মানবো না।
প্রসঙ্গত, নতুন এই সিটি নির্বাচনে নগরপিতা পদে মোট ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দোয়াত-কলম প্রতীকের প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লাহ খান এবং টেলিভিশন প্রতীকের প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নানের মধ্যে। এছাড়া রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আনারস প্রতীকের জাহাঙ্গীর আলম, মেজবাহউদ্দিন সরকার (রুবেল সরকার) প্রতীক হাঁস, রীনা সুলতানা প্রতীক প্রজাপতি, ডা. নাজিমউদ্দিন প্রতীক ঘোড়া।
সাধারণ ভোটারা বলছেন, ব্যালট পেপারে যেহেতু জাহাঙ্গীর আলমের প্রতীক থাকছে তাই সেখানেও ভোট পড়বে। এর ফলে দোয়াত-কলমের ভোটই প্রকৃতপক্ষে কাটা যাবে। ভোট কেন্দ্রে কোনো ধরনের অনিয়ম করার সুযোগ পাবে না সরকারি দলপন্থি প্রিজাইডিং অফিসাররা।
ভোটার সংখ্যা
গাজীপুর ও টঙ্গী মিলে এই সিটিতে মোট ভোটার হলো ১০ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৮ জন। ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রে ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৭৭৭ ও নারী ভোটার চার লাখ ৯৯ হাজার ১৬২ জন। এখানে জয়দেবপুরে ৭ লাখ ৬৪০ এবং টঙ্গীতে ৩ লাখ ২৬ হাজার ২৯৮ জন ভোটার। এই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭ জন প্রার্থী। এছাড়াও ৩৩০ বর্গকিলো মিটারের এই সিটিতে ৫৭টি ওয়ার্ডের জন্য সাধারণ ৪৫৬ জন ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ১২৮ জন কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন।
৬০ ভাগ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ
নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব কেন্দ্র চিহ্নিত করেছেন।
ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অধিকাংশের অবস্থা এতোই খারাপ যে বৃষ্টি হলে ভোটগ্রহণ খুবই কঠিন হবে।
প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা জানান, ত্রিপল দিয়ে চাল ঢেকে দেয়া হয়েছে। এটি হলো যোগীতলা এবতেদায়ী মাদরাসা। এখানে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ১৫৮ জন। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের একটি হলো এমন জায়গায় যেখানে স্যালো নৌকায় করে ভোট দিতে যেতে হবে। আর সেটি হলো কাশিমপুর ধনঞ্জয়খালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। এখানে ১ হাজার ভোটার। এছাড়া সাধারণ কেন্দ্র রয়েছে ১৫৭টি।
তবে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসার মো. মতিয়ার রহমান জানান, সাধারণ কেন্দ্রের চেয়ে এসব কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বেশি থাকবে। ভোটাররা যাতে সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেজন্য প্রশাসন সব রকমের ব্যবস্থা নেবে। নির্বাচনের আগে পরে পুলিশ, র্যাব, আনসার ছাড়াও স্ট্রাইকিং ফোর্স কাজ করবে। থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালতও। এখানে অস্থায়ী ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা হলো ২টি। আর অস্থায়ী ভোট কক্ষের সংখ্যা হলো ৯৮টি। এখানে এমনও কেন্দ্র রয়েছে যেখানে দুটি কক্ষে ১১টি ভোট বুথ করতে বলা হয়েছে।
প্রশ্নবিদ্ধ রিটার্নিং কর্মকর্তা
এদিকে রিটার্নিং অফিসার মো. মতিউর রহমান তার কার্যক্রমকে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। গত ৪ জুলাই প্রিজাইডিং অফিসারদের বৈঠক ডেকে তিনি কোনো ধরনের নির্দেশনা দিতে পারেননি। এমনকি তাদের কেন্দ্র তৈরির জন্য যে ধরনের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিধান রয়েছে সেটাও তিনি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
নিয়ম অনুযায়ী প্রথম দিক থেকে মালামাল সরবরাহ করার কথা। কিন্তু তিনি তার মন মতো করে কেন্দ্রগুলোতে আগে মালামাল বিতরণ করেন বলে প্রিজাইডিং অফিসারদের অভিযোগ। আর ৫ জুলাই সকাল ১০টায় প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের তার কার্যালয় বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে আসতে বলা হয়। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কোনো মালামাল সরবরাহ করতে পারেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ১ থেকে ১১০ পর্যন্ত কেন্দ্রগুলো বিএনপির প্রার্থী এমএ মান্নানের সমর্থন বেশি। তাই ওইসব কেন্দ্রের মালামাল বিলম্বে দেয়া হয়। ফলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের সামনে বেশ ক্ষুব্ধ দেখা যায়।
এ ব্যাপারে মতিউর রহমানের সাথে সরাসরি কথা বলা হলে তিনি বলেন, গাড়ি ও পুলিশ আসতে দেরি করার কারণে আমি মালামাল দিতে পারছিলাম না। এখানে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।
নির্বাচনী কর্মকর্তা
এই নির্বাচন পরিচালনা ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য একজন রিটার্নিং অফিসারের অধীনে ৭ হাজার ২৫৯ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। এর মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসারের সংখ্যা ৩৯২ জন, ২ হাজার ২৮৯ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ৪ হাজার ৫৭৮ জন পোলিং অফিসার।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
যে কোনো নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলোকে দুটি স্তরে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র (ঝুঁকিপূর্ণ) এবং সাধারণ ভোটকেন্দ্র। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় এসব কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। সাধারণ কেন্দ্রে শুধু পুলিশ, আনসার/ভিডিপি, আনসার ব্যাটালিয়ন ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ২২ সদস্য নিয়োগ করা হয়। আর ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে থাকবেন ২৪ সদস্য। এছাড়াও র্যাব ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সার্বক্ষণিক টহল নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি এবার স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বর্ডার গার্ডকেও রাখা হচ্ছে।
৫ হাজার ৯৮৬ পুলিশ ও এপিবিএন (আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ) সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে ৯৪৭ র্যাব সদস্যও। থাকছে ৫ হাজারেরও বেশি আনসার সদস্য। এছাড়া ১০ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ১০টি বিচারিক আদালত ও ৫০ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত দায়িত্ব পালন করবেন পুরো নির্বাচনী এলাকায়। পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় নামানো হয়েছে ১২ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য।
৫৭টি ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণের জন্য স্থাপিত ৩৯৪টি ভোটকেন্দ্রে প্রতিটিতে একজন উপপরিদর্শকের (এসআই) নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মোতায়েন করা হবে বলে জানান এসপি বাতেন। এদিকে জিসিসি নির্বাচনকে সামনে রেখে শুক্রবার থেকেই গাজীপুরের সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে মোড়ে ভ্রাম্যমাণ চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে র্যাবও। র্যাব-১ কর্মকর্তা জানান, সন্ত্রাসী গ্রেফতার ছাড়াও ভোটগ্রহণকে সামনে রেখে কেউ যেন নাশকতামূলক কর্মকান্ড ঘটাতে না পরে সে জন্য তল্লাশি ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এছাড়া গাজীপুরের ওপর দিয়ে যাওয়া ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের ৬টি স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ।
মোবইলে ভোট কেন্দ্রের তথ্য
ভোটাররা যাতে মোবাইল ফোনে মেসেজের মাধ্যমে ভোটার নম্বর ও ভোট কেন্দ্রের নাম জানতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওউ লিখে স্পেস দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর (১৭ ডিজিট) লিখে ২২৩৩ নম্বরে প্রেরণ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র ১৩ ডিজিটের হলে প্রথমে জন্ম সাল লিখে পরিচয়পত্রের নম্বর (১৩ ডিজিট) লিখে ২২৩৩ নম্বরে প্রেরণ করতে হবে। ফিরতি মেসেজে ভোটার নম্বর ও ভোট কেন্দ্রের নাম জানা যাবে।