গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যাংকটির ৯ নারী পরিচালককে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনাদের বাংক (গ্রামীণ ব্যাংক) কেউ
ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমরা আপনাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। পাশে আছি, থাকব। তিনি বলেন, যে ব্যাংক দেশের জনগণের জন্য অবদান রেখে চলছে, সেটাকে তারা ধ্বংস হতে দেবে না। তারাই এটাকে রক্ষা করবে এবং ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকার কি চান- সেটা হবে না। জনগণ কি চান- সেটাই বাস্তবায়ন হবে। গতকাল রাজধানীর রেডিসন হোটেলে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস-২০১৩’ উদযাপন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি জানান এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সামাজিক ব্যবসা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি স্পেনের বার্সেলোনা শহরকে সোস্যাল বিজনেস সিটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসার প্রসারে গ্রামীণ পরিবার অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। অনুষ্ঠানে ৩০টি দেশের দেড় শ’ প্রতিনিধি অংশ নেন। এবারের সামাজিক ব্যবসা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘রূপকল্পকে বাস্তবে রূপান্তর (টার্নিং ভিশন্স ইন টু রিয়েলিটিজ)’। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ১ হাজার অতিথি উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ২৮শে জুন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন। আর গত চার বছর ধরে এ দিনটিকে সামাজিক ব্যবসা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা, জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাধোসিমা, মালয়েশিয়ান রাষ্ট্রদূত টুঙ্কু আলী রেধাউদ্দীন বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকসহ সামাজিক ব্যবসায় জড়িত প্রায় অর্ধশত দেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউনূস সোস্যাল বিজনেস শীর্ষক অভিজ্ঞতা শেয়ার সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোর্শেদ ও হাইতি, জাপান, জার্মানি, নেপাল, ফ্রান্স, স্পেন, আফ্রিকায় চলমান ইউনূস সোস্যাল বিজনেস প্রোগ্রামের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে চীন থেকে আগত প্রতিনিধিরা ড. ইউনূসকে চীনে প্রয়োজন লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, যে প্রতিষ্ঠান দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করেছে সেটাকে অবহেলা করে ধ্বংস করে দেয়া যায় না। এটা মানুষের প্রতিষ্ঠান, মানুষই তা প্রতিহত করবে। সরকার এটাকে দখলে নিচ্ছে এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সরকারকেই জিজ্ঞেস করুন। গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করেছে সরকার গঠিত কমিশন। আর অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটা ঠিক নয়। এ বিষয়ে ইউনূস বলেন, তাহলে তো আর কোন সমস্যা থাকে না। তাহলে তো এটাকে আর নষ্ট করার দরকার নেই। আমি মনে করি, সরকারের এমন উদ্যোগ গ্রামীণ ব্যাংক ধ্বংস করে দেয়ার উদ্যোগ। গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে ফেলার বিষয়ে কমিশন সরকারকে যে সুপারিশগুলো দিয়েছে সেগুলোকে ক্রেজি সুপারিশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ইউনূস। এছাড়া এই ব্যাংক বিষয়ে বিদেশীরাও বেশ উদ্বিগ্ন রয়েছে বলে তিনি জানান। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ড. ইউনূস একজন ভাল রাজনীতিবিদ এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো জানি না। এটা আমার প্রশংসা করলেন নাকি দুর্নাম করলেন। রাজনীতিবিদ হওয়া মানে কি ভাল মানুষ হয়ে গেলাম নাকি খারাপ মানুষ হয়ে গেলাম, এটা পরিষ্কার করতে হবে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে জানিয়ে ইউনূস বলেন, বিএনপি তাকে জানিয়েছে ক্ষমতায় গেলে গ্রামীণ ব্যাংককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে। এছাড়া সমপ্রতি যে পুরস্কার পেয়েছি, সে ব্যাপারে বিএনপি আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বলেন, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অনেক স্বপ্ন রয়েছে। এর অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়েছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে এর কোন বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে আফ্রিকায় ব্যবসার জন্য ও উন্নতির জন্য সোস্যাল বিজনেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সোস্যাল বিজনেস ডে হিসেবে ২৮শে জুন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক আগ্রহ বাড়ছে। এই প্রোগ্রামে যারা এসেছেন তারা এখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে যাবেন বলে তিনি মনে করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের নয় নারী পরিচালকদের ব্যাপারে তিনি বলেন, এরা প্রত্যেকেই ৯ লাখ নারীর প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ এরা সবাই ঋণগ্রহীতা। সোস্যাল বিজনেস শুরু করার জন্য বড় ধরনের কোন তহবিলের প্রয়োজন পড়ে না। এর জন্য মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। এর জন্য বড় কোন ফাউন্ডেশন বা বড় কোন প্রতিষ্ঠানেরও প্রয়োজন পড়ে না বলে মনে করেন ড. ইউনূস।
অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন ম্যাজিক ম্যান ও মহান মানুষ। ক্ষুদ্রঋণের প্রসারে তিনি নতুন নতুন ধারণা দিতে পারেন। গ্রামীণ ব্যাংক, সামাজিক ব্যবসা ও ড. ইউনূস সম্পর্কে বলার সময় তিনি অত্যন্ত আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, একজন গরিব মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হবেন- এ স্বপ্ন একমাত্র ইউনূসই সর্বপ্রথম দেখিয়েছেন এবং সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়নও করেছেন। ক্ষুদ্রঋণের প্রসার বিষয়ে দিনব্যাপী বিভিন্ন সেশন পরিচালিত হয়।
অনুষ্ঠানে ‘উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী, সামাজিক ব্যবসায় যুবশক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবসা ও স্বাস্থ্যসেবা, এনজিও ও সামাজিক ব্যবসা, ক্ষুদ্র অর্থায়নে সামাজিক ব্যবসা’ শীর্ষক বিভিন্ন কর্ম-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
↧
গ্রামীণ ব্যাংক কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না
↧